আপনার কি সবসময় দুর্বল লাগছে! নার্ভের সমস্যায় আক্রান্ত নয় তো! আসুন আগে জেনে নিই নার্ভের রোগ আসলে কী! নার্ভের রোগ অর্থাৎ আমাদের শরীরের যে বিভিন্ন নার্ভ বা স্নায়ু গুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেগুলির রোগ। নার্ভের রোগে আক্রান্ত হলে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়, লেখাটিতে সেগুলি নিয়েও আলোচনা করব। নিচে নার্ভের রোগের সাধারণ কিছু লক্ষণ আলোচনা করা হলো-
লেখাটিতে যা যা থাকছেঃ-
নার্ভের রোগের লক্ষণ কি কি?
১. সংবেদনশীলতায় পরিবর্তন-
⨷ নার্ভের রোগের একটি অন্যতম লক্ষণ হলো সংবেদনশীলতার পরিবর্তন। এতে আপনি যে লক্ষণ গুলো দেখতে পারেন সেগুলি হল-
⨷ আপনার মনে হতে পারে, আপনার শরীরের ভিতরের কোন অংশ যেন আগুনে জ্বলে যাচ্ছে।
⨷ হঠাৎ করেই আপনার সংবেদনশীলতা বেড়ে যেতে পারে। যেমন- সাধারণ একটু আঘাতেই অধিক ব্যথা।
⨷ শরীরের কোন অংশ অবশ হয়ে যাওয়ার মত অনুভূত হতে পারে।
⨷ হঠাৎ করেই শরীরের কোনো অংশে ব্যথার সূত্রপাত হতে পারে।
⨷ ঠান্ডা এবং গরমের পার্থক্য সহজে বুঝতে পারবেন না অথবা বুঝতে সময় লাগতে পারে।
২. চলাচলের সমস্যা-
⨷ হাত অথবা পায়ের পেশি অকারণেই দুর্বল লাগতে পারে।
⨷ হাত অথবা পায়ে কাঁপুনির সৃষ্টি হতে পারে।
⨷হঠাৎ করে মাথা ঘুরে যেতে পারে অথবা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধার তৈরি হতে পারে।
⨷ শরীরের মাংসপেশির আঁকার সাধারণের তুলনায় ছোট হয়ে যেতে পারে।
⨷ হঠাৎ করেই প্যারালাইসিস এর মত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
৩.ব্যথা-
⨷ পেশিতে ব্যথা অনুভূত হতে পারে সাথে সাথে হার্টবিট এর মত অনুভূতি ব্যথার জায়গায় হতে পারে।
⨷ কোমর এবং পিঠে অকারণেই ব্যথা দেখা দিতে পারে।
⨷ হাতে অথবা পায়ে হঠাৎ করেই মনে হবে কেউ যেন সুচ দিয়ে ফুটিয়ে দিচ্ছে।
৪. রক্তচাপ জনিত সমস্যা-
⨷ নার্ভের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তচাপ কখনো বেড়ে যেতে পারে আবার কখনো কমে যেতে পারে। অর্থাৎ ব্লাড প্রেশারে তারতম্য দেখা যেতে পারে।
⨷হৃৎস্পন্দন এর গতি হঠাৎ করেই বেড়ে যেতে পারে।
⨷ পেটে বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা যেতে পারে যেমন- বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ইত্যাদি।
⨷ ঠাণ্ডার সময়েও অত্যধিক ঘাম অথবা প্রচুর গরমেও একদম না ঘামা নার্ভের রোগের ইঙ্গিত বহন করে।
৫. মূত্রাশয়ে সমস্যা-
⨷ নার্ভের সমস্যায় মূত্র থলির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যেতে পারে। যার ফলে মূত্র চাপ প্রয়োগ ছাড়াই নিজে থেকেই বেড়িয়ে আসে।
⨷ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা জনিত সমস্যা-
⨷ হঠাৎ করেই স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে।
⨷ চেষ্টা করেও কোন জিনিসের প্রতি মনোযোগী হতে না পারা।
⨷হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে অবচেতন হয়ে যেতে পারেন।
⨷ মস্তিষ্ক আগের তুলনায় কম সাড়া দেয় অথবা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে আসা।
৬. অন্যান্য লক্ষণ-
⨷ উপরিউক্ত কারণ গুলি ছাড়াও যে সমস্যা গুলি দেখা যেতে পারে সেগুলি হল-
⨷ বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যার সৃষ্টি দেখা যেতে পারে।
⨷ নার্ভের রোগে আক্রান্ত হলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে।
⨷ সামান্যতম শব্দ তেও আপনার বিরক্তি আসতে পারে। সাধারণ দিনের আলোতেই চোখ খুলে রাখতে সমস্যার সৃষ্টী হতে পারে এবং জোড় করে চোখ খুলে রাখলে জল পড়া শুরু হতে পারে।
আশা করি বুঝেছেন নার্ভের রোগের সাধারণ লক্ষণ গুলি কি কি। এই লক্ষণ গুলিই বেশিরভাগ নার্ভের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিতে দেখা যায়
আসুন এবার নার্ভের রোগের সাধারণ কিছু কারণ জেনে নিই-
⪼ পারকিনসন্স রোগ (Parkinson’s disease)ঃ-
এটি একটি ধীরগতির প্রগতিশীল স্নায়বিক ব্যাধি, যা মূলত মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্নায়ু কোষগুলির (নিউরন) অবক্ষয়ের কারণে ঘটে। এটি বিশেষত মস্তিষ্কের বাসাল গ্যাংলিয়া (Basal Ganglia) নামক একটি অংশকে প্রভাবিত করে, যা ডোপামিন নামক রাসায়নিক তৈরি করে। ডোপামিনের ঘাটতি হলে মস্তিষ্ক সঠিকভাবে শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যা পারকিনসন্স রোগের প্রধান কারণ।
⪼ এলএসডি (ALS) বা লুই গেহ্রিগ রোগ-
এলএসডি (ALS), বা অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস (Amyotrophic Lateral Sclerosis), যা লুই গেহ্রিগ রোগ নামেও পরিচিত, এটি একটি গুরুতর ও প্রগতিশীল স্নায়বিক রোগ যা দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের মোটর নিউরনগুলো (Motor Neurons) ধীরে ধীরে নষ্ট হতে শুরু করে। এই মোটর নিউরনগুলো মাংসপেশিকে নিয়ন্ত্রণ করে এগুলি ক্ষয়ের ফলে পেশির নড়াচড়া করার ক্ষমতা কমতে থাকে। এই রোগের ফলে অবশেষে পেশি সম্পূর্ণরূপে কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস দেখা দেয়।
⪼ মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (Multiple Sclerosis)ঃ-
মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (Multiple Sclerosis) বা এমএস (MS) হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী অটোইমিউন রোগ, যা মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড এবং দেহের নার্ভগুলোকে প্রভাবিত করে। এই রোগে, শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুলক্রমে নার্ভ ফাইবারগুলোর মাইলিন (myelin) নামক সুরক্ষামূলক আবরণকে আক্রমণ করে। মাইলিন ধ্বংস হলে নার্ভের উপর জ্বলন সৃষ্টি হয়, ফলে নার্ভ সঠিকভাবে সংকেত পাঠাতে এবং গ্রহণ করতে পারে না। এর ফলাফল হিসেবে শরীরে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
⪼ উপরিউক্ত কারণ গুলি ছাড়াও যে কারণ গুলি রয়েছে সেগুলি হল-
⨷ মস্তিস্কে আঘাতজনিত কারণে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ।
⨷ পরিবারের কোনো ব্যক্তি নার্ভের রোগে আক্রান্ত থাকলে বংশানুক্রমিকভাবে সেই রোগ পরবর্তী জেনারেশনের মধ্যেও দেখা যেতে পারে।
🌐 পড়ুনঃ- চিয়া সিডের গুনাগুন জানেন তো!!
নার্ভের রোগের ব্যায়াম:-
নার্ভের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্যায়াম পেশির অবস্থার উন্নতি করতে সহায়ক, শারীরিক ভারসাম্য রক্ষায় এবং পেশির অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে ব্যায়াম। নার্ভের রোগএর ভিত্তিতে ব্যায়াম ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ ব্যায়াম নিয়ে আলোচনা করা হল।
১.স্ট্রেচিং ব্যায়াম:–
⨷ স্ট্রেচিং বা প্রসারণমূলক ব্যায়াম নার্ভের তীব্রতা কমাতে ও পেশির নমনীয়তা বাড়াতে সহায়ক।
⨷ হ্যামস্ট্রিং স্ট্রেচ: পায়ের পেশি প্রসারিত করতে, শুয়ে থাকা অবস্থায় একটি পা উপরে তুলে স্ট্রেচ করুন।
⨷ কাঁধ এবং ঘাড়ের স্ট্রেচ: ঘাড় এবং কাঁধের স্ট্রেচিং ব্যায়াম স্নায়ুর চাপ কমাতে সাহায্য করে।
২. ভারসাম্য রক্ষার্থে সাহায্য করতে পারে এমন ব্যায়াম-
এক পায়ে দাঁড়ানো: কোনো কিছুর সাহায্য নিয়ে এক পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন।
বসা-উঠা (Sit-to-Stand Exercises): বসা থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন। এটি সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. প্রতিরোধমূলক ব্যায়াম:
মাংসপেশি শক্তিশালী করতে হালকা প্রতিরোধমূলক ব্যায়াম সহায়ক। সঠিকভাবে করা হলে এটি নার্ভাস সিস্টেমের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে।
লাইট ওয়েট ব্যবহার করে পায়ের ও হাতের ব্যায়াম করুন: হালকা ডাম্বেল বা রেসিস্টেন্স ব্যান্ড ব্যবহার করতে পারেন।
৪. কোঅর্ডিনেশন এবং ফাইন মোটর স্কিলের জন্য ব্যায়াম:
এই ব্যায়ামগুলো হাতের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে-
বল থেরাপি: ছোট রাবার বল চাপিয়ে রাখার ব্যায়াম করুন। এটি হাতের পেশি ও নার্ভকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে।
ফাইন মোটর স্কিলের জন্য আঙুলের ব্যায়াম: আঙ্গুলগুলোকে একত্রে চাপিয়ে রেখে, আলাদা আলাদা মুভমেন্ট করানো চেষ্টা করুন, ইত্যাদি।
৫. ক্যাডিয়ো ভাস্কুলার এক্সারসাইজ :
⨷ হালকা কার্ডিও ব্যায়াম যেমন হাঁটা, সাইক্লিং, বা সাঁতার কাটা নার্ভের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
হাঁটা: প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট হাঁটা নার্ভের সঞ্চালন উন্নত করে।
সাঁতার কাটা: সাঁতার অত্যন্ত কার্যকরী ব্যায়াম, যা মাংসপেশির শক্তি ও স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
৬. যোগব্যায়াম (Yoga) এবং প্রাণায়াম (Breathing Exercises):
⨷ যোগব্যায়াম ও প্রাণায়াম নার্ভাস সিস্টেমে প্রশান্তি আনে এবং মানসিক চাপ কমায়, যা নার্ভের স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
⨷ যোগব্যায়াম: কিছু সহজ আসন যেমন শবাসন, ভুজঙ্গাসন, এবং ত্রিকোণাসন নার্ভের ভারসাম্য উন্নত করে।
⨷ শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ ব্যায়াম: ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়া এবং ছাড়া প্রক্রিয়া নার্ভের শিথিলতা আনতে সাহায্য করে।
৭. পেশাদার থেরাপি (Physical Therapy):
⨷ যেকোনো ধরনের নার্ভের রোগের ক্ষেত্রে, একজন ফিজিওথেরাপিস্টের সাহায্য নিয়ে বিশেষ ধরনের চিকিৎসা করা যেতে পারে।
⨷ টেনস থেরাপি Transcutaneous Electrical Nerve Stimulation (TENS) ব্যথা কমাতে ও নার্ভের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
চিকিৎসকের পরামর্শ: প্রতিটি রোগীর অবস্থা ভিন্ন, তাই নার্ভের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম করবেন।
ধীরে শুরু করুন: প্রথমে হালকা ব্যায়াম দিয়ে শুরু করুন এবং ধীরে ধীরে ব্যায়ামের মাত্রা বাড়ান।
ব্যথা হলে থামুন: যদি ব্যায়ামের সময় ব্যথা হয় তবে সেটি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করুন এবং চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
লেখাটিতে শুধু মাত্র একটি বাহ্যিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, কোন পদক্ষেপ গ্রহণের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অবশ্যই গ্রহণ করুন।।
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে- ফেসবুক- মুক্তাক্ষর টেলিগ্রাম- মুক্তাক্ষর WhatsApp Group- মুক্তাক্ষর