দুটি গল্পেই রয়েছে অমূল্য জীবন শিক্ষা। এই শিক্ষামূলক গল্পে জানতে পারবেন কেন প্রতিটি কথা আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে তার গভীরতা বুঝতে হবে। গল্পে আত্মত্যাগ, বুদ্ধিমত্তা, ও বাস্তবতার মূল্য সম্পর্কে জানুন।
অমূল্য জীবন শিক্ষা-
পিতার উপদেশের ভুল ব্যাখ্যা: রমেশের জীবনের করুণ শিক্ষা
গোপালপুর গ্রামের ধনী ব্যক্তি সুনারায়ন চৌধুরি। তার একমাত্র ছেলে রমেশ চৌধুরি অত্যন্ত পিতৃপরায়ণ ছেলে। অন্যদিকে সুনারায়ন বাবু ছেলের জন্য সব কিছু করেছেন। সুনারায়ন বাবুর জীবন গাড়ি তার গন্তব্যের সন্নিকটে পৌঁছে গেছে। মৃত্যু শয্যায় শায়িত সুনারায়ন বাবু ছেলেকে কাছে ডাকলেন।
সুনারায়ন বাবু ছেলেকে বললেন- “বাবু আমি তোর কষ্ট জীবনে সহ্য করতে পারিনি, আর মরে গেলেও সহ্য করতে পারব না। তুই রোদ জলে ভিজিস না আর ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবি।“
সুবোধ বালকের মত রমেশ মাথা নাড়ল।
সুনারায়ন বাবু আবার বললেন- “তুই আমাকে কথা দে বাবা তুই ছায়ায় ছায়ায় বাজারে যাবি আর গোটা গোটা মাছ খাবি। বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব অনেকটা, কাজেই তুই সবসময় ছায়ায় ছায়ায় বাজারে যাবি, আর বাজার থেকে কিনে আনবি গোটা গোটা মাছ।“
রমেশ বলল- “তাই হবে বাবা”
দুইদিনের মাথায় সুনারায়ন বাবু স্বর্গে যাত্রা করলেন। এদিকে বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর রমেশ বাবাকে দেওয়া কথা ভাবতে লাগলো। সে তার বাবাকে কথা দিয়েছে যে সে ছায়ায় বাজারে যাবে আর গোটা গোটা মাছ খাবে।
বাবাকে দেওয়া কথা মতে সে তার বাড়ি থেকে বাজার পর্যন্ত রাস্তার উপর একটি টিনের চালা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভাবনা এবং বাবাকে দেওয়া কথা, দুটোর পূর্ণ প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায় তাকে চালা নির্মাণ করতে। বাড়ি থেকে বাজারে যাওয়ার পুরো রাস্তা সে টিনের চালা নির্মাণ করাতে থাকে। এদিকে টিনের চালা নির্মাণ করতে করতে জমানো সব অর্থ শেষের পথে।
রমেশ সিদ্ধান্ত নেয় সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও সে বাবাকে দেওয়া কথা রাখবে। এরপর সে সম্পত্তি বিক্রি করে টিনের চালা নির্মাণের কাজ বজায় রাখে।
দীর্ঘ তিন মাস পর টিনের চালা নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। রমেশের আর খুশির শেষ নেই। অন্যদিকে মানুষজন রমেশের এরূপ কার্যকলাপে হতভম্ব।
বাবাকে দেওয়া একটি কথা সে পূর্ণ করেছে। এবার তার বাবাকে দেওয়া কথা অনুযায়ী সে গোটা গোটা মাছ প্রতিদিন খেতে শুরু করে।
সে প্রতিদিন সেই টিনের চালা দেওয়া রাস্তার ছায়া ধরে বাজারে যায় আর বাজার থেকে কিনে নিয়ে আসে আস্ত বড় মাছ।
এভাবেই কাটতে থাকে দিন। রমেশ সম্পত্তি বিক্রি করে বাবার কথার পালন করে যাচ্ছে।
এইভাবে প্রায় এক বছর চলার পর রমেশের সব সম্পত্তি ফুরিয়ে যায় শুধু ভিটে মাটি পরে থাকে। রমেশ কাঁদতে থাকে এবং বলে- “বাবা তুমি আমাকে কি আদেশ দিলে এটা, যেটা পালন করতে গিয়ে আজ আমি সব হারালাম। আমার সব শেষ হল তোমার কথা পালন করতে গিয়ে। তাহলে কি এটাই তোমার আমার প্রতি ভালোবাসার প্রতিদান!”
এইভাবে কাঁদতে কাঁদতে রমেশ ঘুমিয়ে যায়। স্বপ্নে তার বাবা তাকে দেখা দেয়। তার বাবা তাকে বলে- “তুই এত বোকা আগে জানতাম না বাপ। আমি তোকে বলেছি ছায়ায় ছায়ায় বাজারে যেতে। অর্থাৎ ছাতা নিয়ে সেই ছাতার ছায়ায় বাজারে যেতে।
আর বলেছি গোটা গোটা মাছ খেতে। কিন্তু তুই তো বাপ প্রতিদিন বড় বড় গোটা গোটা মাছ খাওয়া শুরু করে দিয়েছিস। আমি তোকে বলেছিলাম গোটা মাছ খেতে অর্থাৎ বাড়ির পুকুরে জাল ফেলবি আর সেখান থেকে গোটা গোটা ছোট মাছ যেমন দাড়া পুঁটি এইসব খেতে।
তোর মাথায় এত কম বুদ্ধি আগে জানলে কখনোই তোকে এরকম উপদেশ দিতাম না।
গল্পটি থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
- উপদেশের সঠিক অর্থ বোঝা জরুরি: কোনোকিছু আক্ষরিকভাবে না বুঝে তার গভীর অর্থ বুঝে তা পালন করা উচিত, নতুবা বিপর্যয় ঘটতে পারে।
- অন্ধ আনুগত্য নয়, যুক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন: কোনো প্রতিশ্রুতি পালন করতে গিয়ে যদি যুক্তি এবং বিচারের ব্যবহার না করা হয়, তাহলে তা নিজের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
- সংযম ও বাস্তবতার মূল্য: জীবনের প্রতিটি কাজে সংযম ও বাস্তবতার ব্যবহার করা উচিত। অতিরিক্ততা বা ভুলভাবে কোনো কিছু গ্রহণ করলে জীবন ভারসাম্যহীন হয়ে যায়।
- বুদ্ধিমত্তার সাথে সম্পদ ব্যবহারের প্রয়োজন: সম্পদ বা সম্পত্তি ব্যবহার করার সময় সঠিক পরিকল্পনা ও বিবেচনা জরুরি। অন্যথায় সব হারানোর ঝুঁকি থাকে।
এই গল্প আমাদের শেখায়, শুধু কাজ করলেই চলবে না, সেটার পেছনে সঠিক ভাবনা ও উপলব্ধিও থাকতে হবে।
🌐 পড়ুনঃ- বাস্তব জীবনের শিক্ষণীয় গল্প
ভুল বোঝাবুঝি বনাম আত্মত্যাগ: পাখি ও গাছের গল্প থেকে শিক্ষণীয় বার্তা
বর্ষার দিন আগত প্রায়। একটি পাখি তার বাচ্চা গুলির সাথে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ চালাচ্ছে। সে খুঁজছে এমন একটি গাছ যেটিতে সে বাসা বানালে নিরাপদে থাকবে সে এবং তার বাচ্চা গুলি। খুঁজতে খুঁজতে সে নদীর ধারে দুটি বড় গাছ দেখতে পেলো।
পাখিটি একটি গাছকে গিয়ে বলল- “তুমি কি তোমার ডালে আমাকে বাসা বানানোর অনুমতি দেবে?” এই গাছটি আগে কোনোদিন কোন পাখিকেই তার ডালে বাসা বানাতে বাঁধা দেয় নি। কিন্তু আজ গাছটি সরাসরি পাখিটিকে বলে দিল- “না আমার ডালে তোমাকে কেন বাসা বানাতে দেবো?”
এরপর পাখিটি অন্য গাছের কাছে যায় এবং তাকে জিজ্ঞাসা করে যে তার ডালে সে বাসা বানাতে পারে কি ন! অন্য গাছটি অনুমতি দিয়ে দেয়। এরপর পাখিটি সেই গাছের ডালে বাসা বানায়।
এদিকে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। বর্ষার প্রথম জলেই নদীটি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। হঠাৎ করেই অন্য গাছটি নদীতে উপরে পরে গেল।
এটি দেখে পাখিটি বলল- “তোমার অহংকারেই তোমার পতনের কারণ। তুমি আমাকে বাসা বানাতে দাও নি। এবার দেখলে তো ভগবান কীভাবে তোমাকে শাস্তি দিয়েছেন।“
এটি শুনে ভেসে যাওয়া গাছটি শান্ত ভাবে উত্তর দিল- “আমি জানি যে আমার শিকড় আলগা হয়ে গেছে। বর্ষা এলেই আমি উপরে পরে যাব। তাই আমার ডালে তোমাকে বাসা বানাতে দিয়ে তোমার এবং তোমার বাচ্চা গুলির ক্ষতি আমি চাইনি। যে কারণে আমি তোমাকে মানা করেছিলাম। আমার ওরকম ব্যবহারে তুমি কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু তোমাদের বাঁচাতেই আমি ওরকম ব্যবহার করেছিলাম”
এটি শুনে পাখিটির মুখ চুপসে গেল, আর লজ্জা পেয়ে সে নিজের বাসার ভিতরে ঢুকে গেলো।
শিক্ষণীয় বিষয়:
গল্পটি একটি সুন্দর শিক্ষণীয় বার্তা বহন করে। এখানে অহংকার ও আত্মত্যাগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম গাছটি অহংকারী ছিল না, বরং তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং সেই কারণে সে পাখিটিকে বাসা বানাতে দেয়নি। গল্পটি থেকে আমরা শিখতে পারি যে:
- দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিস্থিতি বিবেচনা করা প্রয়োজন: সবকিছুকে আক্ষরিকভাবে না নিয়ে, তার পিছনের কারণ ও উদ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। পাখিটি প্রথমে গাছের সিদ্ধান্তকে অহংকার হিসেবে নিয়েছিল, কিন্তু পরে বুঝতে পারল যে তা পাখিটির ভালোর জন্যই ছিল।
- অহংকারের পরিবর্তে বিনয়ী ও আত্মত্যাগী হওয়া জরুরি: কখনও কখনও কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, কিন্তু সেটা সঠিক উদ্দেশ্যে হলে তা আসলে ভালো ফল বয়ে আনে।
- তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত না নেওয়া: না জেনে কারও কাজকে ভুলভাবে বিচার করা উচিত নয়। প্রতিটি কাজের পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে যা সঠিক সময়ে উপলব্ধি করা যায়।
🌐 পড়ুনঃ- দুর্বল লাগছে! অজান্তেই এই রোগের শিকার নন তো!
অসীম পাল
গল্পের লিখনে-
আমাদের সাথে যুক্ত হবেন যেভাবে-
ফেসবুক- মুক্তাক্ষর
টেলিগ্রাম- মুক্তাক্ষর
WhatsApp Group- মুক্তাক্ষর